Monthly Archives: June 2022

বৃষ্টির কবিতা

বর্ষার বৃষ্টিতে — নরেশ গুহ

এক বর্ষার বৃষ্টিতে যদি মুছে যায় নাম
এত পথ হেঁটে এত জল ঘেটে কি তবে পেলাম?
এত যে সয়েছি, এত যে পেয়েছি,
দুঃখ-সুখের ধারায় নেয়েছি,
দুচোখে দেখেছি অপার্থিবের, অফুরন্তের ঝর্ণা
প্রকৃতির রীতি মানুষের ঘর-করনা।

মার কোলো শিশু ঘুমে অচেতন,
চুলে বিলি দেয় হাওয়া —
একটি চুমোয় বিশ্বের সব খ্যাতি গৌরব
বিত্তের স্বাদ পাওয়া।

ধিক্কারে ভরা নোংরা নরকে
একটি কথার গানে
শত বার ফিরে জন্ম নেবার
অভিলাষ আনে প্রাণে।

সব আশা যদি চুরমার হয়
ভাঙে ফুলদানী, ভোরের চায়ের বাটি
যে পথে সে আর ফিরবে না
তবু আর একবার সেই পথ দিয়ে হাঁটি।
তৃষ্ণা মেটে না দেখে।
এখন কি তবে জলে লিখে নাম চলে যেতে হবে?
কী তবে পেলাম, কী তবে হলাম!

চিরজীবীদের জয়টিকা আর অসামান্যের মাল্য
প্রতিজ্ঞা করে কেটেছে একদা দেব-দুর্লভ বাল্য।
ছিল না শঙ্কা, মনের কোনায় সন্দেহ ক্ষীণ
শিশু উল্লাসে হাওয়ায় হাওয়ায় সে আমার দিন

রাঙা বুদবুদ উড়িয়ে দিয়েছি চপল খেলায়
আজ যৌবন খর-জীবনের মধ্য বেলায় –
এখন দেখছি কত যে স্বপ্ন কত যে ইচ্ছে
হল না জীবনে পূরণ — কে তার হিসেব নিচ্ছে!

চলতে চলতে নিজেই ভুলেছি, কত না দুপুর
কালো ভ্রমরের পাখায় এনেছে বহিয়া কী সুর
লঘু প্রহরের সে-সুর ছন্দে গাঁথার সময়
পেল না হৃদয়।

দীর্ঘ গ্রীষ্ম কেটে গেছে, কত গানের চরণ
চোখোর সামনে জারুলের শাখা বেগনি বরণ
পুষ্প-প্রদীপে অপব্যয়ের যে উদাহরণ
স্থাপন করেছে, তা দেখে আমার হৃদয় জানতো
আমারো তা হবে। জারুল শাখায় যে অফুরন্ত
আমারো জীবন জারুলের মতো করবে তুচ্ছ

সকল চিহ্ন অবলেপকারী কালের ইচ্ছা
আমিও পারব এ মরদেহের ধ্বংস ভুলতে
হিমে উলঙ্গ কালের শাখায় পুচ্ছ তুলতে।

আমি তো কখনো করি নাই তাই কারো প্রতীক্ষা
হায় দুরন্ত শ্রাবণ, তুমিই দিয়েছ শিক্ষা
হৃদয় শুধুই দু’হাতে বিলাতে, ঝরাতে শুধুই
তোমার মতোই সঞ্চয় আমি রাখিনি কিছুই।

আজ রাত্রিতে বৃষ্টি নেমেছে
একা বিছানায় ঘুম চোখে নেই –
শুয়ে শুনি হাওয়া ডেকে ডেকে যায়
যেন মনে হয়, আজ রাত্রিতে এখানে আসার
কত কাল থেকে রক্তে আমার কথা ছিল কার!

আমাকে অমর করার মন্ত্র সে বুঝি জানত
সে অপার্থিব, সে অফুরন্ত –
সে যেন আমার লক্ষ্য-বিহীন সকল গানের অকুল মোহনা
সে যেন আমার অধীর প্রাণের চির প্রতীক্ষা
হায়, দুরন্ত উতল শ্রাবণ
তোমার শিক্ষা — এই তো করল!
এখন কি শেষে জলে লিখে নাম চলে যেতে হবে?
কি তবে হলাম!

দুঃখের বিয়ে

দুঃখের বিয়ে
উপালি শ্রমণ

দুঃখ তোমার জন্ম হয়েছে কবে?
কোন মাস দিন সময় কয়টা বাজে?
তোমার জন্য পেয়েছি একটি বর,
আসবে কি তুমি সুনীল বরণ সাঁজে?
ভুলো না তোমার বিবাহের দিন ঠিক,
গ্রীষ্মে যখন সূর্যমুখীরা ফোটে,
আকাশের রং নীল তবু চারদিক,
নদীর শুষ্ক বুক ম্লান হয়ে ওঠে।
(জুন ১৮, ২০২২ )

মুক্তি

মুক্তি
উপালি শ্রমণ

গঙ্গা নদীর এক ফোঁটা শুধু জল,
অথবা একটি বোধি বৃক্ষের পাতা।
ছুঁতে পাই যদি মিলবে কি বোধি ফল?
হয়তো পেতাম মুক্তির বার্তাটা।

হঠাত ভোরেই দেখি যদি একদিন,
পুরনো দিনের ঋষি লোভ দ্বেষ হীন।
ছেড়ে যাবো সব দূরে সেই তপোবনে,
হয়তো তখনই শান্তি মিলবে মনে।
(জুন ১৮, ২০২২ )

মেহমান

মেহমান
উপালি শ্রমণ

নদীর পারেই ডাকছে হলুদ পাখি
সারাদিন যেন করে কার আহ্বান,
জানালায় আমি উৎসুক চেয়ে থাকি
বেলা বয়ে যায় আসছে না মেহমান।
সূর্য ডুবেই নেমেছে অন্ধকার,
মনের গভীরে আশার বাতিটি জ্বলে।
বিশেষ অতিথি কথা ছিল আসবার,
তাঁর কথা মনে ঘুম চোখে পরে ঢলে।
এমন করেই কেটে যায় কতো দিন,
হলুদ পাখির বাচ্চা হয়েছে বড়ো।
আমার আশাও একটু হয় নি ক্ষীণ,
বিস্তৃত হয় নদীটির বালু চরও।

সময়

সময়
উপালি শ্রমণ

সময় তোমার সঙ্গে আমার বিশেষ কিছু কথা আছে,
সময় তুমি পুষ্প হয়ে ফুটতে পারো, আমার গাছে?
ইচ্ছে হলেই যখন তখন অল্প সময় নিতাম ছিঁড়ে,
ফুল বাগানে বসে তোমার সুবাস নিতাম ধীরে ধীরে।
নয়তো, সময়, ঘাস যদি হও ঘরের পাশেই নদীর ধারে,
সঙ্গী নিয়ে বসতে যেতাম শয্যা পেতে তোমার ঘাড়ে।
গল্প হবে শত শত থাকবে না আর কাজের ত্বরা,
তোমার সবুজ বুকেই হবে আমার বাকী সকল পড়া।
অথবা এক ভোরে যদি দেখি তুমি পাখি হয়ে,
গাছের ডালে গান গেয়ে যাও মধুর সুরে ছন্দ লয়ে,
একটি সোনার খাঁচায় আমি ধরে নিতাম বন্দী করে,
খাইয়ে পুষে রাখব তখন চিরকালই আমার ঘরে।
এখন তুমি কোথায় থাকো যায় না দেখা, যায় না ছোঁয়া,
তোমার জন্য হিসেব করে, করতে যে হয় খাওয়া শোয়া।
ঘড়ির কাঁটা বন্ধ করে ধরতে যখন চাইছি তোমায়,
অট্টহাসি দিয়েই তোমার দিন চলে যায় রাত চলে যায়।
সময়, আমার ধৃষ্টতাকে নিজ দয়াতে করবে ক্ষমা,
সময় তুমি, অল্প সময় আমার জন্য রাখবে জমা।
অল্প সময় প্রিয়জনের সঙ্গে মনের কথা বলার,
অল্প সময় দেশ দুনিয়ার পথে পথে হেঁটে চলার,
অল্প সময় দূর আকাশে পূর্ণিমা চাঁদ তারা দেখার,
অল্প সময় শতবর্ষী গাছের নীরব কথা শেখার।
অল্প সময় গভীর রাতে জোনাক পোকার শব্দ শোনার,
সময়, তোমার সঙ্গে রেখো হিসেব খাতা সময় গোনার।
(জুন ১৩, ২০২২)

প্রার্থনা ১৯

রাতকে ঢেকে আছে পূর্ণ চন্দ্রিমা
বোশেখী উৎসবে বাদ্য বেজে ওঠে,
পদ্ম পুকুরের পুষ্প কলি যত
সবাই উল্লাসে হঠাত নেচে ওঠে।
অপ্সরার দল স্বর্গ পুরী হতে
আসছে নেমে ধীরে সঙ্গে দেবরাজ,
এনেছে সমাচার ক্লিষ্ট পৃথিবীর
ঘুছবে পরিতাপ, আলোর দিন আজ।
দীর্ঘ বেদনার কাব্য লেখা শেষ
পথের কণ্টক হবে পরিষ্কার,
ঘাসের কুয়াশায় প্রাণের আবেদন
নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন বুকে তাঁর।
কল্পরাজ্য কি হবে না বাস্তব?
এমন জিজ্ঞাসা করেছে কত লোক,
জেগেছে অমিতাভ আলোর উৎসবে
এখন অনন্ত সুখের কথা হোক।

অজানার ভয়

অজানার ভয়
উপালি শ্রমণ

হঠাত যদি ঘুম ভেঙ্গে যায়
মধ্যরাতের নিরবতায়,
শান্ত চারিদিকে।
মনে মনে তখনও কি
ভেসে উঠবে আমার ছবি,
ক্ষণিক নির্নিমিখে?
হয়তো কোনো অস্ফুট স্বর
পুরনো এক দিনের খবর
বলবে কানে কানে।
নদীর কোনো পারে আবার
লক্ষ্য বিহীন হাঁটতে যাবার
মন যদি’ বা টানে,
ঘুমের আবেশ স্বপ্ন ভেবে,
ইচ্ছেটা কি ঠেলে দেবে
নিপুণ অভিনয়ে?
বলার কথা হয় না যখন,
সত্যটাকে রাখবে গোপন,
কোন অজানার ভয়ে?
(জুন ১১, ২০২২ )

জন্মোৎসব

জন্মোৎসব
উপালি শ্রমণ

আগুনে মরছে মানুষ নিজের ঘরে বসে,
তুফানে মরছে কেউ পাহাড়ের চূড়া ধ্বসে ।
কেউ মরে রাজপথে চলন্ত গাড়ির চাপায়,
বর্ণবাদীর গুলিতে কেউবা প্রাণটি হারায় ।
নিষ্পাপ শিশু মরছে যুদ্ধে য়ুক্রেনে,
অসংখ্য লোক ক্ষুধায় মরছে ইয়েমেনে।
লক্ষ রমণী সম্ভ্রমহীন হয়ে পথে আজ,
পরম শান্তি আশায় পরছে মৃত্যুর সাজ।
চারদিক যেন মৃত্যুর এক উলঙ্গ উৎসব,
শুধুই শুনছি স্বজন হারানো কান্নার কলরব ।
সূর্যকে তবু ঘুরছে পৃথিবী, ঘুরছে সময়
দিন মাস করে একটি বর্ষ পূর্ণ যে হয়।
তারপর সব লাশের উপর আমরা আবার দাঁড়িয়ে,
জন্মোৎসব করবো মাংস দগ্ধ বায়ুর নিশ্বাস নিয়ে।

প্রার্থনা ১৮

অন্ধকারে চোখ উন্মীলিত হোক
উপালি শ্রমণ

হঠাৎ প্রলোভনে দৃষ্টি যদি হয়,
নষ্ট কখনো’বা ভ্রান্ত বিশ্বাসে,
হঠাৎ থামে যদি প্রমত্ত হৃদয়,
জীবন ক্ষণিকের সুখের উল্লাসে,
তখনো একটাই আমার মনে আশা,
করো না বঞ্চিত তোমার ভালবাসা,
সহ্য হবে না সে অবহেলার শোক,
অন্ধকারে চোখ উন্মীলিত হোক ।
ফুলের রূপ রস সুবাস মনোহর,
সুদূর নীপবনে করিছে আহ্বান,
ভ্রমর গুঞ্জন হৃদয়ে করে ভর,
আমার কাছে নেই আমার এই প্রাণ।
কোথাও পুরাতন ধ্বনি অনুরণন,
শুনছি ভেসে আসে চঞ্চল এ মন,
যদি বা ক্ষীণ হয় চৈতন্যে আলোক,
অন্ধকারে চোখ উন্মীলিত হোক।